Header Ads

Breaking News
recent

পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজপ্রথা






সুশীল প্রসাদ চাকমা















প্রবাদ আছেঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার।কালের বিবর্তণে প্রবাদটির বাস্তব রুপ এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী তিন রাজার বেলায়। রাজপ্রথা চালু রয়েছে। কিন্তু ঐতিহাসিক শাসনক্ষমতা রাজাদের আর নেই। বহুলাংশে খর্ব একানকার প্রথাগত শাসনক্ষমতা।

বর্তমান তিন রাজার মধ্যে রাঙামাটির চাকমা সার্কেল চিফ রাজা ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায়।  বান্দরবানের বোমাং সার্কেল চিফ কেএসপ্রæ ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি পরলোকগমণ করেন। প্রয়াত রাজা কেএসপ্রæ ২০১২ সালের ২০ নভেম্বর ১৬তম রাজা হিসেবে স্থলাভিষিক্ত হন। অবশ্য তার আগে ১৯ সেপ্টেম্বর রাজা হিসেবে দায়িত্ব নেন। এরপর কেবল পাঁচ মাসের দায়িত্ব পালনের সুযোগ পান তিনি। পরে নিযুক্ত হন বর্তমান রাজা প্রæ চৌধুরী। খাগড়াছড়ি অঞ্চলের মং সার্কেল চিফ হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন রাজা সাচিংপ্রু চৌধুরী।

এককালে পার্বত্য অঞ্চলের তিন রাজার ছিল দোর্দন্ড প্রতাপ আর অসীম রাজকীয় প্রভাব। বিশেষ করে চাকমা সার্কেলের রাজা ছিলেন সবচেয়ে বেশি প্রতাপশালী। কালের বিবর্তণে সেই ঐতিহ্য আর ক্ষমতা খর্ব হওয়ায় রাজাদের অস্তিত্ব আজ অনেকটা হুমকিতে। হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্য। নেই ঐতিহাসিক শাসনক্ষমতা। ইতিহাস আর ঐতিহ্য নিয়ে কোনো রকমে চলছে পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজপ্রথা। চলছে প্রথাগত সামাজিক বিচার-আচার, খাজনা আদায়, ঐতিহ্যগত সংস্কৃতিসহ বিশেষ কার্যাদি।

সম্ভবত: বাংলাদেশে কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামেই আজও চালু রয়েছে রাজপ্রথা। এখানে প্রচলিত আইনের পাশাপাশি কার্যকর প্রথাগত আইনে বিচারকার্য। কিন্তু রাজা, রাজ্য আর  সিংহাসন থাকলেও রাজাদের শাসনক্ষমতা নেই আগের মতো। ফলে রাজারা অনেকটা নামেই। তারপরও এমন তিন রাজার তিন রাজ্য টিকে আছে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে।

তিন রাজার মধ্যে চাকমা রাজার আধিপত্যের গোড়াপত্তন হাজার বছরের আগে। ঐতিহাসিক বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, আনুমানিক ৫০০ সালের দিকে এখানে রাজ্য দখল রাজত্ব শুরু করেন চাকমা রাজবংশীয়রা। সেই থেকে রাজপ্রথার সূচনা। বৃটিশরা প্রথাকে স্বীকৃতি দেয়। পাকিস্তান এবং স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারও পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন রাজার ক্ষমতা, দায়িত্ব এবং অস্তিত্বের স্বীকৃতি দেন। রয়েছে ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধির প্রচলন। আইনটি স্বীকৃত দেশের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক। চাকমা সার্কেলের বর্তমান রাজা ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায় বিগত তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রধান উপদেষ্টার পার্বত্য চট্রগ্রাম বিষয়ক এবং বন পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহাকরীর (প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায়) দায়িত্ব পালন করেন।                            

চাকমা রাজবংশের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস


ইতহাসের সূত্র মতে, হিমালয়ের পাদদেশে শাক্য নামে এক রাজা বাস করতেন। তার রাজধানী ছিল কালপ্পানগর। সেখানে ঈশ্বরের মূর্তি তৈরি করে ধ্যানে মগ্ন থাকতেন তিনি। যানকুনী মন্ত্রীর জন্ম ওই পরিবারে। সুষ্ঠু সুন্দরভাবে রাজ্য চালানোর জন্য তার খ্যাতি ছিল ব্যাপক। সুধন্য নামে শাক্য রাজার ছিলেন এক সাহসী পুত্র। তিনি ক্ষত্রীয় বীরদের মতো শত্রæদের দমন করতেন। রাজা সুধন্যর দুই রাণী তিন পুত্র সন্তান ছিল। প্রথম রাণীর পুত্র গুণধর রাজকীয় আনন্দ ত্যাগ করে মোহমুক্তির উদ্দেশ্যে সন্ন্যাসীর জীবনযাপন করেন।
 
কনিষ্ঠ রাণীর আনন্দ মোহন লাঙ্গলধন নামে দুই পুত্র ছিল। আনন্দ মোহন সিদ্ধার্থের শিষ্য হয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুর জীবন গ্রহণ করেন। দ্বিতীয় পুত্র লাঙ্গলধন রাজা হয়ে রাজ্য শাসন করেন। কিন্তু খুব অল্প বয়সে মুত্যুবরণ করেন তিনি। এরপর লাঙ্গলধনের পুত্র সমুদ্রজিৎ বেশ কয়েক বছর রাজ্য শাসন করেন। কিন্তু তিনিও মাত্র বিশ বছর বয়সে রাজত্ব ত্যাগ করে বৌদ্ধ ভিক্ষুত্ব গ্রহণ করেন। এতে তার সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে। এভাবে বংশ পরম্পরায় রাজ্য পরিচালিত হয়ে আসে। আনুমানিক ৫৯০ সালের দিকে চাকমা যুবরাজ বিজয়গিরি সেনাপতি রাধামন খীসার নেতৃত্বে পরিচালিত যুদ্ধে রোয়াং রাজ্য (বর্তমান রামু), অক্সাদেশ (আরাকান সীমান্ত), খ্যয়ং দেশ, কাঞ্চননগর (কাঞ্চন দেশ) কালজর (কুকিরাজ্য) প্রভৃতি রাজ্য বিজিত হলে বিশালপার্বত্য রাজ্যএর (চাকোমাস) পত্তন ঘটে।

এক সময় ধারা মিয়ার পুত্র মোগাল্যা রাজা হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন। জুবান খাঁ ফতেহ খাঁ নামে তার দুই পুত্র ছিল। মগ জলদস্যুদের সঙ্গে জুবান খাঁর অনেক যুদ্ধ হয়। তার সেনাপতি কালু খাঁ সর্দারের সঙ্গে মুসলমান নবাবদের বড় বড় যুদ্ধ হয়। এসব যুদ্ধে দুটি বড় কামান দখল করে তারা।  সেনাপতি রাজার ভাইয়ের নামানুসারে কামান দুটির নাম রাখা হয় কালু খাঁ ফতেহ খাঁ। বর্তমানে কামান দুটি ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে চাকমা রাজবাড়ীর কাচারীর সামনে রাখা হয়েছে।

ফতেহ খাঁর তিন পুত্র ছিল। তার মৃত্যুর পর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেরমুস্ত খাঁ ১৭৩৭ খ্রিস্টাব্দে রাজা হন। এরপর শেরমুস্ত খাঁর ভাইয়ের পুত্র শের দৌলত খাঁ ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে রাজা হন। এভাবে শের দৌলত খাঁর মৃত্যুর পর তার পুত্র জান বক্স খাঁ ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে, তার মৃত্যুর পর জ্যেষ্ঠ পুত্র জব্বার খাঁ ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে, তার মৃত্যুর পর ধরম বক্স খাঁ ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে, ধরম বক্স খাঁর মৃত্যুর পর রাণী কালিন্দী জমিদারি সংক্রান্ত বিষয়ে ভার গ্রহণ করেন। তিনি চট্টগ্রামের মহামুণি মন্দির নির্মাণ মহামুণি দীঘি খনন করে ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে অমর হয়ে আছেন।
 
১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে হরিশচন্দ্র কালিন্দী রাণীর মৃত্যুর পর রাজা হন। ব্রিটিশ সরকার তাকে চট্টগ্রামের রাজানগর ছেড়ে রাঙ্গামাটিতে বাসস্থান পরিবর্তনের অনুরোধ করে। সেই থেকে চট্টগ্রামের রাজানগর থেকে চাকমা রাজবাড়ী স্থানান্তর হয় রাঙ্গামাটিতে। রাজা হরিশ চন্দ্রের দুই রাণীর দুই পুত্র ছিল। ভুবন মোহন রায় রাণী মোহন রায়। ভুবন মোহন রায় নাবালক থাকা অবস্থায় রাজা হরিশ চন্দ্র মৃত্যুবরণ করলে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে জমিদারি চাকমা রাজার শাসনভার নেয় সরকার। এরপর ১৯০৭ সালে কুমার ভুবন মোহন সাবালক হয়ে সিংহাসনে আরোহণ করেন।

তিনি সফলভাবে রাজ্য পরিচালনার করেন। তার মৃত্যুর পর ১৯৫৩ সালে ত্রিদিব রায় রাজ্যভার গ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রাজা ত্রিদিব রায় বাংলাদেশের বিপক্ষে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করার অভিযোগে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে তিনি পাকিস্তানে চলে যান। সে কারণে তার পুত্র বর্তমান চাকমা সার্কেল চিফ রাজা দেবাশীষ রায় ১৯৭৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর ৫১তম রাজা হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন। রাজা ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায়ের জন্ম ১৯৫৯ সালের এপ্রিল।

চাকমা রাজার শাসন আধিপত্য প্রতিষ্ঠা

জানা যায়, ৬০০ সালের দিকে বিশাল পার্বত্য রাজ্য গঠনের পরপরই পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা রাজার শাসন আধিপত্য প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৫২০ সালে চাকমা রাজা জনুর সময় রাজ্যসীমা ছিল পূর্বে নাম্রে (বর্তমান নাফ নদী), পশ্চিমে সীতাকুন্ড পাহাড়, দক্ষিণে সমুদ্র চাঁইচল পর্বতশ্রেণী।
১৫৫০ সালে জো দি বরোস নামে জনৈক পর্তুগিজের আঁকা মানচিত্রে কর্ণফুলী নদীর পূর্বতীরে দুই নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলেচাকোমাসনামে একটি রাজ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। এর অবস্থান শ্রীহট্ট ত্রিপুরা রাজ্যের দক্ষিণ-পূর্বে এবং আরাকানের উত্তরে অর্থাৎ বর্তমান বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা পর্যন্ত।
১৭১৪ সালের দিকে মুসলিম নবাবদের সঙ্গে চাকমা রাজা জল¬াল খাঁর যুদ্ধ-বিগ্রহ ঘটে। পরে ১৭১৫ সালে চাকমা রাজকুমার ফতে খাঁর সঙ্গে মুসলিম নবাবদের শান্তি স্থাপন হয়।

১৭৬০ সালের ১৫ অক্টোবর নবাব মীর কাশিম চট্টগ্রামের শাসনভার ইংরেজদের হাতে তুলে দেয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামেও ইংরেজদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হয়। ১৭৭৭ ১৭৮১ সালে চাকমা রাজা শের দৌলত খাঁর সঙ্গে ইংরেজদের দুই দফার যুদ্ধে চাকমা রাজার জয়লাভ হয়। এরপর চাকমা রাজা জান বক্স খাঁর সঙ্গে পরপর তিন বছর (১৭৮৩, ১৭৮৪ ১৭৮৫ সাল) যুদ্ধ চলে। পরে ১৭৮৭ সালে চাকমা রাজা জান বক্স খাঁর কোলকাতায় গিয়ে বড়লাটের কাছে ক্ষমা চান এবং বছরে পাঁচশমণ তুলা দেয়ার প্রতিশ্রæতিতে ইংরেজদের সঙ্গে সন্ধি হয়।
 ১৮৪৪ সালে চাকমা রাণী কালিন্দির সঙ্গে ক্যাপ্টেন লুইনের তীব্র দ্বন্ধ হয়। ১৮৬০ সালের আগষ্ট চট্টগ্রাম জেলা থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম নামে একটি স্বতন্ত্র জেলা গঠন করা হয়। ১৮৮১ সালের সেপ্টেম্বরচাকোমাসরাজ্যকে (বর্তমান বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম) তিনটি সার্কেলে বিভক্তিকরণ করা হয়। তার আগে ১৮৭০ সালে ঘোষিত সার্কেল বিভক্তিকরণের বিরুদ্ধে চাকমা রাণী কালিন্দির আপিল অগ্রাহ্য করা হয়।

১৯০০ সালের ১মেসিএইচটি রেগুলেশনবাপার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ১৯০০আইন জারি করে ব্রিটিশরা। ১৯৪৭ সালের ২০ আগষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রামে পাকিস্তানের শাসন প্রতিষ্ঠা হয়।
১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে রাঙ্গামাটির চাকমা রাজবাড়িসহ ৫৪ হাজার একর আবাদি জমি ¬াবিত হয়। উদ্বাস্ত হয় প্রায় এক লাখ মানুষ। ১৯৬৩ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকেউপজাতীয় এলাকাহিসেবে চিহ্ণিত করে পাকিস্তান সরকার। ১৯৭০ সালের পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে স্বতন্ত্র সদস্য নির্বাচিত হন চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়। ১৯৮৯ সালে তিন পার্বত্য জেলায় স্থানীয় সরকার পরিষদ (পরে জেলা পরিষদ) প্রবর্তিত আইনে এবং ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথাগত নেতৃত্ব ১৯০০ সালের শাসনবিধি বহাল রাখা হয়।

রাজপ্রথা

রাজা-প্রজার সেই প্রাচিন সম্পর্ক এখন আর খুব একটা দেখা যায় না। বাংলাদেশে জমিদারি অধিগ্রহণ আইনের আওতায় (পাকিস্তান আমলেই) সব রাজ-রাজাদের রাজত্ব বিলুপ্ত হয়েছে। কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামেই আজও চালু রয়েছে রাজপ্রথা। প্রথাগত রীতিতেই আদিবাসীদের সামাজিক জীবনযাপন।

পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং এর অধিবাসীদের ঐতিহাসিক পটভূমিকায় অঞ্চলের তিনটি প্রধান জনগোষ্ঠী চাকমা, মারমা এবং ত্রিপুরাদের নিয়ন্ত্রিত তিনটি প্রশাসনিক এলাকা বা রাজস্ব সার্কেল সৃষ্টি ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু বৃটিশ শাসকদের দৃষ্টি ভঙ্গির কারণে তা হতে পারেনি। ১৮৬০ সালের পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা ছিল দুই দলপতির হাতে। মোগল শাসনের সময়ও দুই জমিদার বা সার্কেল চিফ যথাক্রমে চাকমা রাজা পোয়াং (বোমাং) রাজা হিসেবে রাজস্ব আদায়ের স্বীকৃতি ছিল। ১৭৬১ সালে চট্টগ্রাম ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধিকারভূক্ত হলে কোংলাপ্রæ মগ বা মারমা আদিবাসীদের দলপতি হিসেবে বান্দরবান এলাকার রাজস্ব আদায়কারী নিযুক্ত হন। এরপর ১৯০০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সার্কেল তিনটি গঠিত হলে কোংলাপ্রæ পরিবারের বোমাং খেতাবের স্মারকরুপে বোমাং সার্কেলের নামকরণ এবং তাকে ওই সার্কেলে চিফ নিযুক্ত করা হয়।

প্রচলিত আইন রাজপ্রথার  সঙ্গে কোন তফাৎ আছে কিনা জানতে চাইলে রাজা দেবাশীষ বলেন, আলাদা করে দেখলে আলাদা। কিন্তু যুগ অনুসারে আমরা যদি চলতে না পারি তাহলে ব্যর্থ। তবে জনগণ যদি কিছু গ্রহণ করতে না চায়- এর বিকল্প তারাই ব্যবস্থা নেবে। পার্বত্য এলাকায় বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতি-গোষ্ঠীর বসবাস। তাদের সংস্কৃতি লালন পালন, সংস্কার, সংযোজনে আমাদের কিছু ভূমিকা থাকে। প্রচলিত আইন রাজপ্রথার সঙ্গে তেমন কোনো সাংঘর্ষিক বিষয়বস্তু নেই। বিচারের ক্ষেত্রে ১৯০০ সালের হিল ট্র্যাক্টস ম্যানুয়েল সংস্কার করে ২০০৩ সালে দেওয়ানি ফৌজদারি আদালত চালু করা হয়। ফলে সিভিল প্রশাসন বা কমিশনার আদালতে যেতে হয় না। পর্যায়ক্রমে আইন কানুন সংস্কার হচ্ছে। এর ফলে রাজা বা হেডম্যান প্রথার সঙ্গে দেওয়ানি ফৌজদারি পদ্ধতির একটি সহাবস্থানের সুযোগ হয়েছে।

খাজনা আদায়

তিন পার্বত্য জেলায় রাজপ্রথা চালু থাকায় প্রতি বছর আড়ম্বড়পূর্ণ পরিবেশে রাজপূণ্যাহ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে খাজনা আদায় করেন তিন সার্কেল প্রধান। তিন পার্বত্য জেলার ভূমি রাজস্ব ঐতিহ্যগত রাজপ্রথার মাধ্যমে হেডম্যানরা আদায় করেন। তারা আদায় করা খাজনার অর্থ জমা করেন সরকার, রাজা এবং হেডম্যানের অংশ পৃথকভাবে।
 
রাঙ্গামাটির রাজবাড়িতে অনুষ্ঠিত রাজপূণ্যাহ অনুষ্ঠানে চিরাচরিত নিয়মে চাকমা সার্কেলের মৌজা হেডম্যানদের কাছ থেকে খাজনা আদায় এবং ঐতিহ্যবাহী নিয়মে তরবারি সমর্পণের মাধ্যমে হেডম্যানরা রাজার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। ২০০৩ সালের ১৬ ফেব্রæয়ারি রাজ্যাভিষেকের রজতজয়ন্তী রাজা দেবাশীষের ছেলে রাজপুত্র ত্রিভূবন আর্য্যদেব রায়কে যুবরাজ হিসেবে অভিষিক্ত করতে এক আড়ম্বড়পূর্ণ রাজপূণ্যাহ আয়োজন করে চাকমা রাজপরিবার। ওই অনুষ্ঠানে দেশী-বিদেশী অতিথিরা উপস্থিত ছিলেন।
খাজনা প্রসঙ্গে রাজা দেবাশীষ বলেন, আমরা মূলত: তিন ধরনের খাজনা আদায় করে থাকি। এগুলো হচ্ছে- জুম খাজনা পরিবার পিছু বাৎসরিক টাকা। এরমধ্যে রাজার অংশ আড়াই টাকা। বাকি অংশ পায় সরকার। জমির খাজনা আদায় করা হয় গ্রোভল্যান্ড (উঁচুভূমি) এবং ফ্রিঞ্জল্যান্ড (নিচুভূমি) থেকে। খাজনার মধ্যে রাজার অংশ ৪২, হেডম্যান ২৭ এবং বাকি অংশ সরকারের।
 
পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধিমালার ৪৩() বিধি মতে, সব শ্রেণির প্রজার নিকট থেকে হেডম্যান খাজনা আদায় করবেন। গ্রোভল্যান্ড ব্যতীত অন্যান্য ভূমি থেকে আদায়কৃত খাজনার জন্য কি পরিমাণ কমিশন প্রদান করা হবে তা সময় সময় সরকার নির্ধারণ করবে। হেডম্যান আদায়কৃত খাজনা জেলা প্রশাসকের নিকট জমা দেবেন। জেলা প্রশাসক কারণ উল্লেখপূর্বক সংশ্লিষ্ট সার্কেল চিফ মৌজা হেডম্যানের সুপারিশক্রমে জুম খাজনা হ্রাস বা মওকুফ করতে পারেন।

মৌজা হেডম্যানরা নিজ নিজ এলাকার প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করে থাকেন। আদায় করা খাজনা প্রতি বছর রাজপুণ্যাহ অনুষ্ঠানে রাজার কাছে জমা দেন তারা। নিয়মতি রাজপুণ্যাহ আয়োজন করা না হলে হেডম্যানরা আদায় করা খাজনা সুবিধা মতো সময়ে পরিশোধ করতে পারেন।

রাঙামাটি চাকমা সার্কেল

রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলার ৫টি রাজস্থলী উপজেলার ৯টি মৌজা বাদে খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলার ২১টি, খাগড়াছড়ি সদরের ১২টি এবং রাঙ্গামাটি জেলার ১৪৪টি মৌজাসহ মোট ১৭৭টি মৌজা নিয়ে চাকমা সার্কেল গঠিত। মৌজাগুলোর প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন হেডম্যান বা মৌজা প্রধানরা। তারা প্রথাগত নিয়মে সামাজিক বিচার-আচারসহ স্থানীয়ভাবে সামাজিক সমস্যাগুলোর সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
 
১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধির ৪৭ ধারার আইন অনুযায়ী বিভাগীয় কমিশনারের মঞ্জুরী সাপেক্ষে সার্কেল প্রধান যে মৌজার অধিবাসী সে মৌজাকে খাস মৌজা হিসেবে অধিকারে রাখতে পারেন সার্কেল চিফ বা রাজা। সেক্ষেত্রে মৌজা প্রধান হিসেবে তিনিও নিজে  হেডম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। হেডম্যানের জন্য নির্ধারিত সম্মানী ভাতা পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন তিনি।
 
বর্তমানে চাকমা সার্কেল চিফ চারটি মৌজা নিজের দায়িত্বে পরিচালনা করেন। সার্কেল চিফরা জেলা প্রশাসকের উপদেষ্টা কাউন্সিলর হিসেবে পরিগণিত হন। এছাড়া সংশ্লিষ্ট সার্কেল সংক্রান্ত  বিষয়ে তথ্য উপদেশ দিয়ে জেলা প্রশাসককে সহায়তা করেন। সার্কেল চিফরা তাদের কর্তৃত্বের প্রভাব বলয়ের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সার্কেলের আওতাধীন মৌজাগুলোতে জেলা প্রশাসকের আদেশ কার্যকর নিশ্চিত করে থাকেন। তারা ব্যক্তিগত তত্ত¡াবধানে রাজস্ব আদায়, গণশান্তি, কল্যাণমুখী প্রশাসন ইত্যাদি বিষয়ে মৌজা হেডম্যানদের দক্ষতা অর্জনের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন।
 
আইনের ৪০ ধারা মতে, প্রচলিত রীতি অনুসারে উপজাতীয় বিরোধগুলো বা হেডম্যানদের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষেিত প্রেরিত বা হেডম্যানরা নিজেরাই দাখিল করেছেন এমন বিরোধগুলোর বিচার সার্কেল চিফরা নিষ্পত্তি করেন। এছাড়াও সার্কেল চিফদের আরও অনেক দায়িত্ব ক্ষমতা রয়েছে প্রথাগত আইনে।
সার্কেল চিফ বা রাজা বর্তমানে সরকার থেকে মাসিক সম্মানী ভাতা পেয়ে থাকেন। এছাড়া আদায়কৃত জমির খাজনার ৪২ ভাগ পেয়ে থাকেন।

চাকমা সার্কেলের ৫১তম রাজা দেবাশীষ

পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি ১৯০০ সালের আইনের ৪৮ ধারা মতে, সার্কেল প্রধান বা রাজার পদে অভিষিক্তকরণ প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে সরকার। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের পর রাজা ত্রিদিব রায় পাকিস্তান চলে যাওয়ায় শূন্য হয় রাজ সিংহাসনটি। স্বাধীনতা পরবর্তী তৎকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মালেক উকিল ১৯৭৩ সালের ৩০ এপ্রিল রাঙ্গামাটি সফরকালে চাকমা রাজার বাড়িতে বেড়াতে যান। ওই সময় তিনি রাজা ত্রিদিব রায়ের পুত্র দেবাশীষ রায়ের ১৮ বছর বয়স পূর্ণ হলে তাকে সিংহাসনে বসানোর সম্মতি দেন।
পরে রাজপদে অভিষিক্তকরণের বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ২৫//৭৪ খ্রিস্টাব্দ তারিখের ৪১৫ শাখা () প্রজ্ঞাপন মূলে নিয়োগ আদেশ জারি করা হয়েছিল। তারই আলোকে ১৯৭৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ায় দেবাশীষ রায় আনুষ্ঠানিকভাবে রাজ সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি রাঙ্গামাটি চাকমা সার্কেলের ৫১তম রাজা। রাজা দেবাশীষ রায় যুক্তরাজ্য হতে বার-অ্যাট- ডিগ্রি লাভ করেন। বর্তমানে চাকমা রাজা দেবাশীষ রায় জনগণের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত।

চাকমা রাজপরিবার জানায়, ১৯৫৪ সালে রাজা নলীনাক্ষ রায়ের মৃত্যুর পর তার পুত্র ত্রিদিব রায় রাজার সিংহাসনে বসেন। রাজা ত্রিদিব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি পাকিস্তান চলে যান। সে সময় তার পুত্র দেবাশীষ রায় নাবালক ছিলেন। সেজন্য রাজা ত্রিদিব রায়ের ছোট ভাই কুমার সুমিত রায় রাজ প্রতিনিধির দায়িত্বে কাজ করেন।

প্রশাসনিক ব্যবস্থা

১৮৬০ সালে পার্বত্য রাজ্য বিভক্ত হয় তিনটি সার্কেলে। এতে প্রতিষ্ঠা হয় পৃথক তিন রাজার শাসনব্যবস্থা। সার্কেল তিনটি হল রাঙ্গামাটি চাকমা সার্কেল, বোমাং সার্কেল মং সার্কেল। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ১৯০০ সালের আইন অনুযায়ী রাজাদের প্রথাগত শাসনব্যবস্থা প্রচলিত।

চাকমা সার্কেল: কাপ্তাই উপজেলার ৫টি রাজস্থলী উপজেলার ৯টি মৌজা বাদে রাঙ্গামাটি জেলার ১৪৪টি মৌজা এবং খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলার ২১টি লক্ষীছড়ি উপজেলার ১২টি মৌজাসহ মোট ১৭৭টি মৌজা নিয়ে গঠিত চাকমা সার্কেল। সার্কেলে রাঙ্গামাটি জেলার মোট দশটিসহ ১২ প্রশাসনিক উপজেলা অন্তর্ভূক্ত।

সার্কেলে চাকমাসহ বসবাস রয়েছে বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠী, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, পাংখোয়া, লুসাই, খুমি, বম, বনযোগী অন্যান্য। বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় লাখ। এর আয়তন ২৪৯৭ বর্গমাইল। সার্কেলে শিক্ষিতের হার শতকরা ৬০। তবে চাকমাদের শিক্ষিতের হার ৮০।  

বোমাং সার্কেল: বান্দরবান জেলার ৯৫টি মৌজা এবং রাঙ্গামাটি জেলার রাজস্থলী উপজেলার ৯টি কাপ্তাই উপজেলার ৫টি মৌজাসহ মোট ১০৯টি মৌজা নিয়ে বোমাং সার্কেল গঠিত। সার্কেলে অন্তর্ভূক্ত মোট প্রশাসনিক উপজেলা। এর আয়তন ১৯৩৪ বর্গমাইল। জনসংখ্যা প্রায় লাখ।

মং সার্কেল: লক্ষীছড়ি উপজেলা দীঘিনালা উপজেলা বাদে খাগড়াছড়ি জেলার মোট ৮৩টি মৌজা নিয়ে গঠিত মং সার্কেল। সার্কেলে অন্তর্ভূক্ত কেবল প্রশাসনিক উপজেলা। এর আয়তন ৭০৪ বর্গমাইল। জনসংখ্যা প্রায় লাখ অধিক।

বর্তমানে তিন পার্বত্য জেলায় জেলা, উপজেলা, ইউনিয়নসহ সব প্রশাসনিক ব্যবস্থা সরকারের নিয়ন্ত্রণে। সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, উন্নয়ন বোর্ড, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ, জেলা প্রশাসন, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে সব উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। তবে প্রথাগত আইন অনুযায়ী স্থায়ী বাসিন্দার সনদ প্রদান, খাজনা আদায়, সামাজিক কিছু বিচার-আচার রাজা (সার্কেল চিফ), হেডম্যান (মৌজা প্রধান) কারবারিরা (গ্রাম প্রধান) করে থাকেন।
 
পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ১৯০০ সালের আইনের ৪৮ বিধি অনুযায়ী সার্কেল প্রধান বা রাজার পদে অভিষিক্তকরণ সরকার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সার্কেল চিফদের সঙ্গে পরামর্শ করে মৌজা হেডম্যান কারবারিদের নিয়োগ বরখাস্ত করতে পারেন সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক। তবে বিষয়টি বাধ্যতামুলক নয়। ওই আইনের ৩৮ বিধি মতে, সার্কেল চিফরা সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের উপদেষ্টা হিসেবে পরিগণিত হন। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সার্কেলের প্রশাসন সংক্রান্ত সব বিষয়ে তথ্য উপদেশ দিয়ে জেলা প্রশাসককে সহায়তা করেন। চিফরা তাদের ক্ষমতাবলে সংশ্লিষ্ট সার্কেলের আওতাধীন মৌজাগুলোতে জেলা প্রশাসকের আদেশ কার্যকরীকরণে নিশ্চিত করেন। এছাড়া সার্কেল চিফরা ব্যক্তিগত তত্ত¡াবধানে রাজস্ব আদায়, গণশান্তি, কল্যাণমুখী প্রশাসন ইত্যাদি বিষয়ে মৌজা হেডম্যানদের দক্ষতা অর্জনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেন। আইনের ৪০ বিধি মতে, প্রচলিত রীতি অনুযায়ী উপজাতীয় বিরোধগুলো বা হেডম্যানদের প্রেরিত বিরোধগুলোর বিচার করেন সার্কেল চিফরা। এছাড়াও সার্কেল চিফদের আরও অনেক দায়িত্ব রয়েছে।

বিশেষ আইন

বৃটিশ আমল থেকেই পার্বত্য অঞ্চলই একমাত্র এলাকা যেখানে বিচার ব্যবস্থা আইনের প্রয়োগ সারাদেশে প্রচলিত আইন বিচার ব্যবস্থা থেকে ভিন্নতর ব্যতিক্রমধর্মী। কিছু আইন আছে যা দেশের অন্যান্য অঞ্চলে প্রযোজ্য হলেও পার্বত্য জেলায় কার্যকর নয়। যেমন খাসজমি বন্দোবস্তু প্রদানের জন্য প্রণীত নীতিমালা। আবার দেওয়ানি কার্যবিধি আইন (১৯০৮ সনের ৫নং আইন) পার্বত্য জেলায় পুরোপুরি কার্যকর নয়। পার্বত্য জেলায় জেলা প্রশাসক পদাধিকার বলে সিভিল কোর্টের বিচারক (যুগ্ম জেলা জজের ক্ষমতাসম্পন্ন) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯০০ সালের আইন অনুযায়ী চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার তিন পার্বত্য জেলার দায়রা জজের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিন পার্বত্য জেলায় অর্থ ঋণ পারিবারিক আদালত নেই।

আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে আদিবাসী বাঙালি জনগণের শ্রেণিভেদে দেশের সব জনগণের জন্য প্রযোজ্য হলেও পার্বত্য জেলায় পাহাড়ি আদিবাসী জনগণের জন্য সেই আইন প্রযোজ্য নয়। যেমন- আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ এর ৬ষ্ঠ তফশীলের পার্ট- অংশে ২৭ ২৮নং অনুচ্ছেদ সংযোজন করে বর্তমানে বলবৎ যে কোনো আদেশ বা রেগুলেশনে যা কিছু বলা থাকুক না কেন তিন পার্বত্য জেলায় পাহাড়ি আদিবাসী জনগণকে দেশের অন্য জেলাগুলোর সীমাবদ্ধ অর্থনৈতিক কর্মকান্ড থেকে উদ্ভূত আয় সম্পূর্ণ করমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে।

পার্বত্য জেলায় প্রযোজ্য আইনগুলো হচ্ছে- পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রবিধান ১৯০০, পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিমালা ১৯০০, বাজারফান্ড বিধিমালা ১৯৩৭, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি অধিগ্রহণ প্রবিধান ১৯৫৮, পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন ১৯৮৯ (১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তির পর সংশোধিত জেলা পরিষদ আইন ১৯৯৮), পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ১৯৯৮, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার ভূমি খতিয়ান প্রস্তুতের বিধান প্রণয়নের অধ্যাদেশ ১৯৮৪ (১৯৮৫ সনের ২নং আইন), ভূমি খতিয়ান (পার্বত্য চট্টগ্রাম) অধ্যাদেশ ১৯৮৪, পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলাসমূহ (আইন রহিত, প্রয়োগ বিশেষ বিধান) আইন ১৯৮৯ (১৯৮৯ সনের ১৬নং আইন), পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিস্পত্তি কমিশন আইন ইত্যাদি। এসব আইন ছাড়াও অন্য আইনগুলো পার্বত্য অঞ্চলে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রবিধান ১৯০০ সনের ১নং রেগুলেশন দ্বারা পার্বত্য এলাকার শাসন কার্য বিচার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত। এছাড়া পার্বত্য জেলায় অন্য কোনো আইন সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে প্রয়োগ কিংবা সংশোধনী আনতে হলে সরকারকে অবশ্যই গেজেট জারির মাধ্যমে কার্যকর করতে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি-১৯০০ অনুসারে পার্বত্য জেলাগুলোর প্রশাসন ভূমি ব্যবস্থাপনা পয়িচালিত হয়। আইন অনুযায়ী পার্বত্য জেলা প্রশাসক জেলার সিভিল জজ হিসেবে দেওয়ানি মামলাগুলোর বিরোধ নিস্পত্তি করে থাকেন। আইনের ১০নং বিধি অনুযায়ী পার্বত্য জেলার দেওয়ানি মামলায় জেলা প্রশাসকের দেয়া আদেশের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের নিকট আপিল করা যাবে।

আইনে বিবিধ দলিলপত্র যেমন স্থাবর সম্পত্তি বিক্রি, দান কবলা, বাটোয়ারা এবং বন্ধক সংক্রান্ত বন্ড নোট ইত্যাদি রেজিস্ট্রিকরণ হয়ে থাকে। সরকার বা জেলা প্রশাসক কর্তৃক বিষয়ে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোন কর্মকর্তা রেজিস্ট্রেশন অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

আইনে সরকারি ভূমি বন্দোবস্তু, হস্তান্তর, বিভক্ত এবং সাবলেট সংক্রান্ত ধারা অনুযায়ী কেবল পাহাড়ি এবং -পাহাড়ি স্থায়ী বাসিন্দা পরিবারকে সর্বোচ্চ পাঁচ একর চাষযোগ্য ভূমি বন্দোবস্তু প্রদান করা যাবে। তবে জেলা প্রশাসক যদি বন্দোবস্তু গ্রহীতার কার্যক্রম সন্তোষজনক মনে করেন ওই পরিবারকে সর্বোচ্চ ১০ একর পর্যন্ত গ্রোভল্যান্ড বন্দোবস্তু দিতে পারবেন। বন্দোবস্তুপ্রাপ্ত গ্রোভল্যান্ড তিন বছর খাজনামুক্ত ভূমি হিসেবে গণ্য হবে।

সরকার বা ভূমি মন্ত্রণালয়ের পূর্বানুমোদন ছাড়া কোন বহিরাগতকে কৃষি কিংবা গ্রোভল্যান্ড আবাদের মতো ভূমি বন্দোবস্তু দেয়া যাবে না। এক্ষেত্রে প্রচলিত বাজার মূল্যের ৫০ ভাগ সেলামি আদায়সহ প্রচলিত হারে খাজনা করা হবে।

গ্রোভল্যান্ড বলতে অপেক্ষাকৃত নিচু সমতল স্ফীত ভূমি পর্বত বা পর্বশ্রেণির পাদদেশে অবস্থিত নিচু পাহাড়ের টিলা বা প্রায় সমতল বনের অংশ যা কেবল ফলের বাগান অন্যান্য বাগান সৃজনের জন্য ব্যবহৃত হয়।

বাণিজ্যিক ভিত্তিতে রাবার বাগান অন্যান্য বাগান সৃজনের মতো ভূমি জেলা প্রশাসক সর্বোচ্চ ২৫ একর পর্যন্ত এবং বিভাগীয় কমিশনার সর্বোচ্চ ১০০ একর পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদি লীজ দিতে পারেন। ভূমি মন্ত্রণালয়ের পূর্বানুমোদন ছাড়া একশএকরের অধিক ভূমি উদ্দেশ্যে দীর্ঘমেয়াদি লীজ প্রদান করা যাবে না।

আইনে জেলা প্রশাসক শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য পৌর এলাকার বাইরে সর্বোচ্চ ১০ একর এবং পৌর এলাকায় পাঁচ একর পর্যন্ত ভূমি আগ্রহী শিল্প উদ্যোক্তাদের নিকট দীর্ঘমেয়াদি লীজ প্রদান করতে পারেন। এক্ষেত্রে বাজার মূল্যের শতভাগ সেলামি দিতে হবে। তবে পাহাড়ি এবং -পাহাড়ি স্থায়ী বাসিন্দারা ৫০ ভাগ হারে সেলামি প্রদানের সুবিধা পাবেন। আইনে জেলা প্রশাসক জুমচাষ বন্ধ রাখা অথবা জুম চাষের জন্য অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ করার ঘোষণা দিতে পারেন। হেডম্যান তার মৌজার সম্পদ সংরক্ষণের জন্য দায়ী থাকবেন। প্রত্যেক জুমচাষিকে স্ব স্ব হেডম্যানের নিকট জুম খাজনা প্রদান করতে হবে। হেডম্যান জুমচাষ সংক্রান্ত তৌজি সংরক্ষণ করবেন।

বিচার ব্যবস্থা

১৯০৮ সনের দেওয়ানী কার্যবিধি আইনটি পার্বত্য জেলাগুলোতে সরাসরি প্রযোজ্য না হলেও ১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশনের ১৮ ধারা অনুসারে প্রণীত পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধিমালার বিধিতে দেওয়ানী মামলার প্রসেস জারি বা কার্যকরীকরণের ক্ষেত্রে কিংবা কমিশন বা ডিক্রি তামিলকরণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিচারক যথাসম্ভব দেওয়ানি কার্যবিধি অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা আছে। ৪নং বিধিতে আপিল আবেদনে পাহাড়িদের কোর্ট ফি প্রদান হতে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এছাড়াও পার্বত্য এলাকায় রাজস্ব মামলায় অর্থাৎ বন্দোবস্তু, জমি পরিত্যাগ অথবা খাজনা মওকুফের দরখাস্ত, নাম জারি জমা খারিজ, সীমানা চিিহ্নতকরণ ইত্যাদি কার্যক্রমে উপস্থাপিত আবেদনপত্রে পাহাড়িদের কোনো প্রকার কোর্ট ফি প্রদান করতে হয় না। তবে ফৌজদারি আদালতগুলোতে সমতল জেলাগুলোর মতই ফৌজদারি কার্যবিধি, দন্ডবিধি সাক্ষ্য আইনের ব্যবহার প্রয়োগ যথারীতি হয়ে থাকে।

অন্যদিকে পাহাড়ি জনগণের ব্যক্তিগত আইন পরিচালিত হয় রেগুলেশানের ৪৮ বিধির অধীন নিযুক্ত হেডম্যান সার্কেল চিফদের মাধ্যমে প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী। আইনের ৪০ বিধিমতে মৌজা হেডম্যান সার্কেল চিফরা সামাজিক রীতিনীতি প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী উপজাতীয় বিরোধগুলোসহ কিছু কিছু ফৌজদারি অপরাধের বিচার করে থাকেন। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪ ধারামতে সার্কেল চিফদের সীমিত পরিসরে বিশেষ ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা প্রদান করা হয়ে থাকে। কিন্তু উপজাতীয় বিষয়ে বিরোধ বিরোধ নিস্পত্তির জন্য মৌজার হেডম্যান সার্কেল চিফদের ক্ষমতা থাকলেও তাদের কোন প্রকার নির্বাহী ক্ষমতা দেয়া হয়নি।

উপজাতীয়দের মধ্যে সামাজিক বিরোধ, উত্তরাধিকার দ্বন্ধ, বিবাহ, ডিভোর্স ইত্যাদি ব্যক্তিগত আইনের বিচার ব্যবস্থা, প্রচলিত প্রথা, সামাজিক রীতিনীতি, অভ্যাস, প্রচলিথ সংস্কারের ভিত্তিতে নিস্পত্তি হয়ে থাকে। বিধিবদ্ধ সামাজিক আইন না থাকার কারণে রেগুলেশানের ৪০ বিধিমতে জেলা প্রশাসক ১০ বিধিমতে বিভাগীয় কমিশনারের নিকট আপিলের সুযোগ রয়েছে। তবে সচরাচর দেখা যায় প্রায় ক্ষেত্রে উর্ধতন আদালত হেডম্যান সার্কেল চিফদের প্রদত্ত আদেশ বহাল রাখেন।

রেগুলেশানের ৪৮ বিধিমতে পারিবারিক ঐতিহ্য উত্তরাধিকার হিসেবে হেডম্যানের পুত্র হেডম্যান হন। হেডম্যান সার্কেল চিফ যদিও সামাজিক বিষয়ে বিরোধ নিস্পত্তি করে থাকেন কিন্তু বিধিবদ্ধ সামাজিক আইন না থাকায় সামাজিক বিচারের আদেশ কার্যকর করতে আইনগত বাধ্যবাধকতা আরোপ করার ক্ষমতা হেডম্যান সার্কেল চিফদের হাতে নেই। কেবল সামাজিক বিরোধের ক্ষেত্রে হেডম্যান ২৫ টাকা এবং সার্কেল চিফ ৫০ টাকা জরিমানা করার ক্ষমতা রাখেন।

অন্যদিকে পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনের (১৯৮৯ সনের ১৯, ২০ ২১নং আইন) ৬৬ ধারায় উপজাতীয় বিষয়ে বিরোধ নিস্পত্তি সংক্রান্ত ব্যাপারে বলা হয়েছে- () পার্বত্য জেলার উপজাতীয়দের মধ্যে কোন সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা উপজাতীয় বিষয়ে বিরোধ দেখা দিলে বিষয়টি নিস্পত্তির জন্য স্থানীয় কারবারি বা হেডম্যানের নিকট উত্থাপন করতে হবে এবং তিনি সংশ্লিষ্ট উপজাতীয়দের মধ্যে প্রচলিত রীতিনীতি অনুযায়ী বিরোধ নিস্পত্তি করবেন।

() কারবারির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হেডম্যান, হেডম্যানের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সার্কেল চিফ এবং সার্কেল চিফের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের নিকট আপিল করা যাবে এবং কমিশনারের সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত হবে।
() সার্কেল চিফ বা কমিশনার কোন আপিল নিস্পত্তির পূর্বে সংশ্লিষ্ট উপজাতি তার মনোনীত তিন বিজ্ঞ ব্যক্তির সঙ্গে পরামর্শ করবেন।
() পরিষদ প্রবিধান দ্বারা ধারায় উল্লেখিত বিরোধ নিস্পত্তির জন্য ) বিচার পদ্ধতি ) বিচারপ্রার্থী আপিলকারী কর্তৃক প্রদেয় ফিস নির্ধারণ করতে পারবে।
এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইনে বলা হয়েছে উপজাতীয় রীতিনীতি, প্রথা ইত্যাদি এবং সামাজিক বিচার সমন্বয় তত্ত¡াবধান করা আঞ্চলিক পরিষদের অন্যতম কাজ।

পার্বত্য অঞ্চলে কৃষি জীবনজীবিকা

পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে কৃষিই হচ্ছে এখানকার মানুষের আদিম জীবনজীবীকা। এখানে কৃষির আদিম প্রকৃতি মূলতঃ অভিন্ন। ভূমির প্রকৃতি মাটির গঠন বিন্যাসও প্রায় এক রকম। তবে রাঙ্গামাটি জেলার কৃষির পদ্ধতির কিছুটা ভিন্নতা পরিবর্তন এসেছে ১৯৬০ সালে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের পরে। অন্য দুই জেলার তুলনায় রাঙ্গামাটি জেলায় ভিন্ন আবহে কৃষি চাষাবাদ হয়ে থাকে। বর্তমানে এখানে চাষাবাদ হয় তিন পদ্ধতির। পাহাড়ে জুম চাষ, পাদদেশে আধুনিক চাষাবাদ এবং জলেভাসা জমিতে চাষাবাদ।
বর্তমানে এখানকার মানুষ কৃষি ছাড়াও চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্ষুদ্র কুটির শিল্প, কাপ্তাই লেকে মাছ ধরাসহ আত্ম-কর্মসংস্থানমুলক বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত।

জুম চাষ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রধান আদিম জীবিকা ছিল জুম চাষ। জুম চাষই ছিল কৃষি। আদিকাল থেকে আজও জুম চাষ প্রচলিত পাহাড়ে। বাংলাদেশের কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামেই ভিন্ন ধরনের কৃষি পদ্ধতি জুম চাষ হয়ে থাকে।

জুম চাষ হয় খাড়া পাহাড়ের গায়ে ঢালু জমিতে। আগুন-পৌষ মাসে পাহাড়ের জঙ্গল ঝোঁপঝাড় কেটে - মাস রোদে শুকানোর পর ফাল্গুণ-চৈত্র মাসে আগুনে পোড়ানো হয়। এরপর বৈশা-জৈষ্ঠ মাসে পোড়ামাটি সাফ করে শুঁচালো দা দিয়ে গর্ত খু
ড়ে ধান, যব, তুলা, ভূট্টা ইত্যাদি বীজ বপন করা হয়। এছাড়া তিল, কাউন, মরিচ, বেগুন ইত্যাদি শস্য সবজির বীজ একসঙ্গে ছিটানো হয় জুমে। জুমের ফসল ঘরে তোলা শুরু হয় আষাঢ়-শ্রাবণ মাস থেকে। শেষ হয় আশ্বিন-কার্তিক মাসে। জুম চাষে কলা, হলুদ, আদা পেঁপেসহ বিভিন্ন ফলমুল মসলার চাষও হয়ে থাকে একসঙ্গে। জুম পদ্ধতির বাইরেও পাহাড়ের পাদদেশে লাঙ্গ চাষের মাধ্যমে আধুনিক পদ্ধতির চাষাবাদ হয় পাহাড়ে। বর্তমানে পার্বত্যাঞ্চলে সমতল ভূমিতে কৃষি চাষের বিস্তৃতি ঘটছে। কৃষকরা আধুনিক পদ্ধতির অনুসরণ এবং উন্নত প্রযুক্তি প্রয়োগ করছেন এতে।
 
এছাড়া রাঙ্গামাটি জেলায় প্রতি বছর শুকনো মৌসুমে জলেভাসা জমিতে কৃষি চাষ হয়। ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে সৃষ্টি হয় বিশাল কাপ্তাই হ্রদ। এর ফলে কৃষি পরিবেশে এখানকার মানুষের জীবনজীবীকায় সৃষ্টি করেছে ভিন্নতর পরিস্থিতি।বর্তমানে কাপ্তাই হ্রদের জলমগ্ন প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জলেভাসা জমিতে শুকনো মৌসুমে চাষ হয় ধান, তরমুজ, শাক-সবজিসহ বিভিন্ন অর্থকরী ফসলের। এসব জলেভাসা জমিতে কৃষকদের চাষাবাদের সুবিধার জন্য বিভিন্ন সময়ে পানির উচ্চতা নিয়ন্ত্রণে মাসওয়ারি একটি নির্ধারিত রুলকার্ভ অনুসরণ করা হয়। কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট জানায়, অব-উঞ্চ আবহাওয়ার ফলে রাঙ্গামাটিসহ পার্বত্য এলাকার মাটি জমি উচ্চতা স্তর ভেদে বেলে দোঁয়াশ এঁটেল দোঁয়াশ। ক্রান্তীয় মৌসুমী জলবায়ু দ্বারা বৈশিষ্টমন্ডিত এলাকার বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ২৫৪ সেন্টিমিটার থেকে ৩৮১ সেন্টিমিটার, যা চাষাবাদের জন্য বেশ সহায়ক। খুবই গরম রৌদ্রকরোজ্জ্বল এলাকায় নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত শীত ঋতু এবং জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বর্ষা ঋতু থাকে। সময়টা গরম, মেঘলা আর্দ্র। এখানে সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা ২৫ দশমিক ৩৪ এবং সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রা ১২ দশমিক ৩৫।

সংস্কৃতি উৎসব

সেই প্রাচিন কাল থেকেই এতিহ্যবাহী আদিবাসী বর্ণাঢ্য নান্দনিক লোকজ সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ পার্বত্য অঞ্চল। অঞ্চলের বৈচিত্রময় আদিবাসী সংস্কৃতি দেশে-বিদেশে আকর্ষণীয়। ভিন্ন ভাষাভাষি জাতিসত্তার নানান জাতিগোষ্ঠী বাঙালি অধ্যুষিত রাঙ্গামাটিসহ পার্বত্য অঞ্চলের বিস্তীর্ণ জনপদে রয়েছে নিজস্ব জীবনধারার সংস্কৃতির চেতনা। পাহাড়ের আদিবাসী সমাজ পূর্বপুরুষদের স্বার্থক উত্তরাধিকার হিসেবে নিজস্ব জীবনধারায় তাদের আপন সংস্কৃতি আজও বুকে আগলে ধরে রেখেছে গভীর মমতায়। সভ্যতার বিকাশে উপজাতীয় পোশাকে পরিবর্তন ঘটলেও ভাষা, আহার্য, পানীয়, সংস্কার বিশ্বাসে তারা আজও নিজেদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি ধরে রেখেছে। আদিবাসীরা আহার্য, পানীয়, পরিধেয় বস্ত্র, অলংকার, বসবাসেরস বাড়িঘর, ধর্মীয় মঠ, মন্দির, সাংসারিক জীবনের জিনিষপত্র, যুদ্ধ, শিকার মাছধরা ইত্যাদিতে ব্যবহার্য অস্ত্রশস্ত্র, যন্ত্র-সঙ্গীত নৃত্যে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র, খেলাধুলার সাজ-সরঞ্জাম ব্যবহার সংরক্ষণে রেখেছে নৈনন্দিন জীবনে জড়িয়ে। এখানকার শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত নৃত্যকলা আদিম সংস্কৃতি চেতনাবাহিত।

পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতি বাংলাদেশের অপরাপর অঞ্চল থেকে স্বতন্ত্র। আচার, প্রথা, সংস্কার, ধর্ম, পূজা-পার্বণ, উৎসব, বিবাহরীতি, কৃষি, গ্রহায়ণ, খাদ্যাভ্যাস, সাহিত্য, সঙ্গীত, নৃত্যকলা এসব ক্ষেত্রে বলা চলে সামগ্রিক জীবন চেতনায় এখানে বিরাজমান যে স্বাতন্ত্র্যধারা তা বৃহত্তর বাঙালি সংস্কৃতি থেকে বহুলাংশে পৃথক ঐতিহ্যমন্ডিত। অঞ্চলে জ্ঞাতি সম্পর্ক, সালিশ, বিচার, যাদুমন্ত্র, বশীকরণ, চিকিৎসা, জন্ম, বিবাহ, সাহিত্য, নৃত্যগীত, মৃত্যুপরের বিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠানসহ এসবক্ষেত্রে বাংলাদেশের অপরাপর অঞ্চল থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। পাহাড়ের আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের মধ্যে বৌদ্ধ, সনাতন, খ্রিষ্টান ধর্মে বিশ্বাসী। ধর্মীয় আচার পালনে তারা নিষ্ঠ। পূজা-পার্বণের ক্ষেত্রে ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছাড়াও বিজু, সাংগ্রাই, বৈসুক, নবান্ন, হালপালনি, গাঙ্পূজা ইত্যাদি উৎসব পালন করে থাকে আদিবাসীরা। পাহাড়ি ওঝা, বৈদ্য তান্ত্রিকদের প্রভাবও রয়েছে এখানে। বিবাহ ক্ষেত্রে রয়েছে বৈচিত্র রীতি। সমাজে প্রতিষ্ঠিত রীতিনীতি মেনে চলে সবাই।

চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে আদিবাসীদের সবচেয়ে বড় সামাজিক উৎসব আয়োজন হয়। উৎসবকে চাকমারা বিজু, মারমারা সাংগ্রাই, ত্রিপুরারা বৈসুক, তঞ্চঙ্গ্যারা বিষু নামে তিন দিন পালন করে। উৎসবে মেতে ওঠে নারী-পুরুষ সবাই। এছাড়া বিভিন্ন সামাজিক পারিবারিক উৎসব পালন করে আদিবাসীরা।

পোশাক-পরিচ্ছদ অলংকার ব্যববহারে আদিবাসী নারীদের স্ব স্ব জাতিসত্তার পরিচয় মেলে। চাকমা নারীরা পিনন, খাদি, মারমারা থামি, ত্রিপুরাদের রিনাই রিসা ইত্যাদি ঐতিহ্যবাহী জাতীয় পোশাক। অলংকারের মধ্যে আদিবাসী নারীরা বালা, মালা, চুড়ি, পুঁতি কড়ির মালাসহ নানান বৈচিত্রময় অলংকার পরিধান করে নিজেদের সাজগোজ করে রাখে।

লেখক: সভাপতি, রাঙ্গামাটি রিপোর্টার্স ইউনিটি সাংবাদিক, দৈনিক যুগান্তর

No comments:

Powered by Blogger.