Header Ads

Breaking News
recent

চাকমা সমাজের বিবাহ রীতি


আনন্দ জ্যোতি চাকমা
পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রায় চৌদ্দটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতির বসবাস রয়েছে। তাদের নিজস্ব স্বকীয় জীবন প্রণালী দেশের অপরাপর সংখ্যাধিক্য জাতি থেকে স্পষ্টতই পৃথক বলে চিহ্নিত করা যায়। শতাব্দীকাল ধরে চাকমা জাতি পার্বত্য অঞ্চলে বসবাস করে আসছে। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল ছাড়াও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, মিজোরাম, অরুণাচল প্রদেশ এবং বার্মার আরাকান রাজ্যে চাকমাদের স্থায়ী বসতি রয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।

সংস্কৃতি জাতীয় মূল্যবোধ: সংস্কৃতি (ইংরেজি : Culture) শব্দের আভিধানিক অর্থ চিৎপ্রকর্ষ বা মানবীয় বৈশিষ্ট্যের উৎকর্ষ সাধন। ইংরেজি Culture -এর প্রতিশব্দ হিসেবে সংস্কৃতি শব্দটি ১৯২২ সালে বাংলায় প্রথম ব্যবহার শুরু হয় (তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া) সাধারণত কোন স্থানের মানুষের আচার-ব্যবহার, জীবিকার উপায়, সংগীত, নৃত্য, বাদ্য, সাহিত্য, নাট্যশালা, সামাজিক সম্পর্ক, ধর্মীয় রীতি-নীতি, শিক্ষা-দীক্ষা, ইত্যাদির মাধ্যমে যে অভিব্যক্তি প্রকাশ করা হয়, তাই সংস্কৃতি। কিন্তু সংস্কৃতি শব্দের বহুমাত্রিক অর্থ রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, নৃত্য, গীত, বাদ্য থেকে শুরু করে মানুষের দৈনন্দিন আচার-আচরণ, খাওয়া-দাওয়া, চলন-বলন, ঘর-বাড়ি, পোষাক-পরিচ্ছদ, চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা, দর্শন সবকিছুই সংস্কৃতির অংশ। এককথায় মানুষের গোটা জীবন প্রণালীটাই সংস্কৃতি। তাই সংস্কৃতির সাথে তার জীবনধারা, জীবিকা, উৎপাদন প্রণালী, উৎপাদন শক্তি সম্পর্ক নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। সংস্কৃতি একদিকে যেমন আরোপিত অর্থাৎ উত্তরাধিকারসূত্রে পাপ্ত তেমনি তা অর্জিতও বটে। একটি জাতির স্বকীয় সাংস্কৃতিক চেতনার মানদন্ডের উপর নির্ভর করে তার জাতীয় মূল্যবোধ গড়ে ওঠে।

চাকমা সমাজে বিবাহ রীতি: বিবাহ হল একটি সামাজিক বন্ধন বা বৈধ সামাজিক চুক্তি যার মাধ্যমে  দু’জন মানুষের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপিত হয়। চাকমা সমাজে বিবাহ রীতি শতাব্দীকাল ধরে প্রচলিত হয়ে আসছে। সংস্কৃতি কখনও এক জায়গায় স্থির থাকে না। সময় বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে সংস্কৃতি প্রতিনিয়ত ভিন্নরূপ লাভ করে থাকে। পরিবর্তনের ইতিবাচক নেতিবাচক উভয় দিকই বিদ্যমান। বিশেষত গ্রাম শহরাঞ্চলে এর প্রভাব চরমভাবে পরিলক্ষিত হয়। বিশ্বায়ন আকাশ সংস্কৃতির প্রবল আগ্রাসনে ছোট ছোট গোষ্ঠীবদ্ধ জাতিসমূহের সংস্কৃতি আজ নানাভাবে হুমকির পর্যায়ে রয়েছে। চাকমা সমাজও এর ব্যতীক্রম নয়।

চাকমা বিবাহ কার্য সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক আনুষ্ঠানিকতা প্রতিপালন করতে হয়। গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজে সাধারণত বর কনের মধ্যে আত্মীয় কুটুম্ব সম্পর্কের উপর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ব্যাপারটি নির্ভর করে।

উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে, বর কনের মধ্যে আত্মীয়তা যদি সম সম্পর্কের হয়, যেমন কনে বরের মামাতো, মাসতুতো বা পিসতুতো সেই ধরনের কোন আত্মীয় সম্পর্কের হয়, তবে তাদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক হতে পারে। তবে চাকমা সমাজে চাচাতো ভাইবোন সম্পর্কের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ। খালাতো ভাই বোন সম্পর্কের মধ্যে বিবাহ হতে কোন বাধা নেই।

এবার চাকমা সমাজের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। চাকমা বিবাহ রীতি অনুসারে যথেষ্ট আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেই বৈবাহিক কার্যাদি সম্পন্ন করতে হয়। নিম্নে এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা হল।

) চাকমা সমাজের রীতি অনুযায়ী বর পক্ষের অভিভাবকদেরকে কনে পক্ষের পিতামাতার নিকট কমপক্ষে তিনবার যেতে হয়। বর পক্ষের অভিভাবকদেরকে কনের বাড়িতে আনুষ্ঠানিকভাবে যাওয়ার সম্য় নানাবিধ খাদ্যদ্রব্য উপহার সামগ্রী নিয়ে যেতে হয়। উল্লেখ্য, শেষবারে অর্থাৎ তিন পুরে যাবার সময় উপহার সামগ্রীর পাশাপাশি অবশ্যই একটি মদের বোতল নিয়ে যেতে হয়। এই মদের বোতল পাত্রের অভিভাবককে কনের অভিভাবকের নিকট তুলে দিতে হয়। এটিকে ‘মদপিলাংÕ গজ বলা হয়। এই মদের বোতল কনের অভিভাবক গ্রহণ করলে বিবাহে তাদের সম্মতি আছে বলে ধরে নেয়া হয়। এবং সাথে সাথে উভয় পক্ষের পরামর্শ ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে বিবাহের দিন ক্ষণ ধার্য করা হয়।

) নির্ধারিত দিনে বরযাত্রীরা শুভক্ষণ দেখে কনের বাড়িতে রওনা হয়। বরযাত্রীদের দলে কয়েকজন বয়স্ক পুরুষ স্ত্রীলোক সহ কিছু সংখ্যক যুবক যুবতী থাকে। তবে বরযাত্রীদের দলে কোন বিধবা কিংবা বন্ধ্যা স্ত্রীলোককে সাথে নেয়া হয়না। বরযাত্রীদের মধ্যে একজন সধবা স্ত্রীলোক থাকেন যাকে ‘বউ ধরনীÕ বলা হয়। বউ সাজানোর জন্য উপহার সামগ্রী যেমন, কাপড়-চোপড় অলঙ্কার বহণ করতে বরযাত্রীরা একটি ফুলবারেঙ (ফুরবারেঙ) নিয়ে যায়। ফুলবারেঙ সাধারণত বরের ছোটবোন সম্পর্কীয় কেউ একজন আত্মীয়া বহন করে থাকেন। বউয়ের উপহার সামগ্রী হিসেবে যাই কিছু নেয়া হোক না কেন সেগুলি অবশ্যই জোড় সংখ্যার হতে হবে। এটি নব দম্পতির সাংসারিক জীবনের মঙ্গল হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
) শুভযাত্রার প্রাক্কালে বরযাত্রী দলের সবাইকে বরের বাড়িতে দুমঠো খাবার খেয়ে যাওয়ার রীতি রয়েছে।

) বরযাত্রীরা কনের বাড়িতে পৌঁছলে সেখানে তাদেরকে অভ্যর্থনা জানানো হয়। কনের বাড়ির লোকেরা বরযাত্রী দলকে নানাভাবে আপ্যায়ন করে থাকে। আপ্যায়িত হবার পর বউ সাজানোর পর্ব চলে আসে।

) বউ সাজানোর পর একটি কুলায় বীজযুক্ত তুলাসহ কিছু চাল নিয়ে আসা হয়। কনের পিতামাতা উপস্থিত অন্যান্য আত্মীয় স্বজনেরা কনের বিদায় কালে কুলা থেকে কিছু পরিমাণ তুলা সাথে কিছু চাল নিয়ে কনের মাথায় স্পর্শ করে আশীর্বাদ প্রদান করে থাকে। বীজযুক্ত তুলা এবং সাদা চাল দীর্ঘ জীবন সচ্ছলতার প্রতীক হিসেবে মনে করা হয়। আর তুলার বীজ বংশবৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে।

) নতুন বউকে বাড়িতে তোলার ব্যাপারে চাকমা সমাজে কতগুলো রীতি অনুসরণ করতে হয়। প্রথমে মূল দরজার সামনে নতুন বউ নিয়ে বরযাত্রীরা হাজির হলে বরের একজন কনিষ্ঠ ভাই অথবা বোন বউয়ের পা ধুয়ে দেয়। তারপর বরের মা এসে বউয়ের বাম হাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুলে একটি সুতা দিয়ে বেঁধে ঘরে তোলেন। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার পূর্ব পর্যন্ত তাকে একটি আলাদা কামরায় (সাজঘর) রাখা হয়।

) বিবাহের শুভলগ্ন উপস্থিত হলে বর কনেকে একসাথে পাশাপাশি বসানো হয়। সাধারণত কনে বরের বাম পাশে বসে থাকে। এরপর যিনি সাবালার দায়িত্বে থাকেন তিনি একখানা সাত হাত লম্বা সাদা কাপর দিয়ে সমবেত আত্মীয় পরিজন মুরুব্বী জনদের নিকট উচ্চস্বরে ‘অমুক আর অমুকের জরা বানি দিবার উগুম আঘেন’ বলে অনুমতি প্রার্থনা করেন। উপস্থিত সকলে ‘আঘে আঘে’ বললে তখন সাবালা মহোদয় বর কনের কোমর পেঁচিয়ে সাদা কাপড় দিয়ে তাদেরকে যুক্ত করেন। অনুষ্ঠানের পর্বের নাম ‘জরা বানাহ্’ অনুষ্ঠান। জরা বেঁধে দেবার পর আবার জরা খুলে দেবার জন্যও উপস্থিত সুধী মহলের অনুমতি নিয়ে জরা খুলে দিতে হয়।

) জরা বেঁধে দেবার পর আসে ‘চুঙুলাং পূজা’ অনুষ্ঠান। সমাজে স্বামী স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হলে অবশ্যই নব দম্পতিকে ‘চুঙুলাং পূজা’ অনুষ্ঠান সেরে নিতে হয়। সাধারণত গ্রামের একজন ওঝা পূজা সম্পন্নের ক্ষেত্রে পৌরহিত্য করে থাকেন। চুঙুলাং পূজা অনুষ্ঠান চুকে গেলে নব দম্পতি উপস্থিত মুরুব্বি সবাইকে প্রণাম জানিয়ে দাম্পত্য জীবনের সুখ-সমৃদ্ধি কামনা করে থাকে। তখন উপস্থিত সবাই বীজযুক্ত তুলা চাল দিয়ে নব দম্পতিকে আশীর্বাদ করেন। আর্থিক অসঙ্গতির কারণে বা অন্য কোন বিশেষ কারণে কেউ চুমুলাং করতে সমর্থ না হলে সাময়িকভাবে শুধু বর কনের জোরা বেঁধে দিলেও ওরা সমাজে স্বামী স্ত্রী রূপে বসবাস করতে পারে। ক্ষেত্রে সমাজে কোন প্রশ্ন উঠতে পারেনা। পরে একটা সুবিধা মত সময়ে চুমুলাং করে সমাজের প্রাপ্য খানাটা চুকিয়ে দিলেই চলে। একে বলে ‘খানা সিরানা’ বিয়ের খানায় ‘টক’ একটা অপরিহার্য উপাদান, যাকে চাকমা ভাষায় ‘খাদা’ বলে। খাদা খাওয়া না হলে ‘খানা সিরানা’ ব্যাপারটাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। 

) এরপর শুরু হয় বিবাহের শুভ কার্যাদি উপলক্ষে আমন্ত্রিত অতিথিদের খাবার আয়োজনের পালা। বিয়ের তিনদিন পর নতুন জামাই বউকে নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে যায়। বেড়াতে যাওয়াকে চাকমা সমাজে ‘বিষুদ ভাঙানা’ বলে থাকে। ছাড়াও গোষ্ঠী ভেদে চাকমা বিবাহ রীতিতে আরও বিশেষ কিছু নিয়ম নীতি পালন করা হয়।

বর্তমান সময়ে আধুনিকতার নামে চাকমা বিবাহ রীতিতে নানা ধরনের পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। চাকমা বিবাহ রীতির বর্ণিত শতাব্দীকাল ধরে প্রচলিত রীতির বাইরে গিয়ে ইদানিংকালে অনেকে বৌদ্ধ মন্দিরে গিয়ে কিংবা বাড়িতে বৌদ্ধ ভিক্ষু ফাং করে বিবাহ কার্য সম্পাদন করতে দেখা যাচ্ছে। বৌদ্ধ ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী নব দম্পতিকে বিবাহ কার্য সম্পাদনের কোন উদাহরণ অতীতে বৌদ্ধ সমাজে ছিল কিনা জানা নেই। আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, অনেক চাকমা যুবক যুবতী সামাজিকভাবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ না হয়ে রাষ্ট্রীয় বিবাহ আইন অনুসরণ করে কেবল মাত্র কোর্ট মেরিজ (আইনি বিবাহ) করে একটি মাত্র দলিল করে স্বামী স্ত্রীর মর্যাদা নিয়ে বসবাস করে থাকেন। ধরণের দালিলিক বিবাহকে চাকমা সামাজিক রীতি কখনো স্বীকার করেনা এবং সম্মান মর্যাদার চোখে দেখে না।  আমাদের সামাজিক আইন, রীতি প্রথা আমাদেরই মেনে চলা উচিত। যদি তার কোনরূপ ব্যত্যয় ঘটে তাহলে বিজাতীয় সংস্কৃতি আমাদের স্বকীয় সংস্কৃতিকে গ্রাস করে বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দেবে বৈকি!


(লেখক: শিক্ষক, রাঙ্গামাটি বি এম ইনস্টিটিউট, রাঙ্গামাটি।)

No comments:

Powered by Blogger.