Header Ads

Breaking News
recent

অজানা পাহাড়ী সুরে একজন রোমান্টিক বরেন ত্রিপুরাকে আবিষ্কার


 




মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা








উনিশশো ষাট-সত্তরের দশকে পাকিস্তান আর্টস কাউন্সিল, রাঙ্গামাটি শাখাকে কেন্দ্র করে অবিভক্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজধানী হিসেবে বিবেচিত রাঙ্গামাটিতে আদিবাসী কৃষ্টি-সংস্কৃতি বিকাশের একটি ধারা শুরু হয়েছিল উদীয়মান বহু তরুণ তখন এই আর্টস কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে নানা গান কবিতা রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন বলে জানা যায় সেই সময় প্রাণচঞ্চল কিছু তরুণ মিলে গঠন করেছিলেন সবশনি সাহিত্য গোষ্ঠি নামের একটি সাহিত্য সংগঠনসবশনিনামের পেছনে ছিল একটি মিষ্টি প্রেক্ষাপট সলিল রায়, বরেন ত্রিপুরা, শফীক উদ্দীন নির্মলেন্দু চৌধুরী মিলে এই সংগঠনটি গড়ে তুলেছিলেন তাঁদের চারজনের নামের আদ্যাক্ষর নিয়েই গঠিত হয়েছিল এই সংগঠন- সলিল রায়ের’, বরেন ত্রিপুরার’, শফীক উদ্দীনেরএবং নির্মলেন্দু চৌধুরীরনি পুলক জাগানোর মতো ব্যাপারই বটে এই আর্টস কাউন্সিলকে দেওয়ার জন্যে তাঁরা বহু কালজয়ী গান রচনা করেন বাংলা, চাকমা ত্রিপুরা ভাষায় বরেন ত্রিপুরা এই চার খলিফার একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন তিনিও তাঁর মাতৃভাষা ককবরক বাংলায় বহু গান রচনা করেন এই কাউন্সিলের জন্যে পাশাপাশি গ্রামে গ্রামে ঘুরে সংগ্রহ করেন বহু লোক গান আধ্যাত্মিক সংগীত ১৯৬৬ সালে তাঁর নিজের লেখা সংগ্রহ করা গান মিলে মোট ২৫টি গানের সংকলন হিসেবে প্রকাশিত হয়অজানা পাহাড়ী সুর পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্যতিত সমতলের মানুষের কাছে তখনো পাহাড়ের সাংস্কৃতিক সৌন্দর্য সংগীতের মূর্ছনা অনেকটা অজানাই ছিল তাই তিনি এই অজানা পাহাড়ী সুরগুলো পৌঁছিয়ে দিতে চেয়েছেন সমতলের মানুষদের কাছে তাঁর মতে, ‘আমি আমার জাতির অর্ধ বিলোপ-প্রাপ্ত কৃষ্টি সংস্কৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করার সংকল্প নিয়েই লিখে যাব আমার ক্ষুদ্র গানের কলি তথা কবিতাগুচ্ছ’ 

শ্রী বরেন ত্রিপুরা (ছবিটি সংগৃহিত)

 
১৯৬৬ সালের ১১ জুলাই তারিখে প্রকাশিত প্রথম সংস্করণের চেহারা দেখার সুযোগ একবিংশ শতকের প্রজন্মের হয়নি- আমারও হয়নি তবে ককবরক পাহাড়ের সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে কিছুটা আগ্রহ থাকার সুবাদে স্কুল জীবন থেকেইঅজানা পাহাড়ী সুরসম্পর্কে শুনেছিলাম, দেখার সুযোগ পাইনি আমার এক-দুইটা লেখায় এই বইটি সম্পর্কে ছোটখাটো তথ্যও দিয়েছি খাগড়াছড়িতে সম্প্রতি লেখালেখি নিয়ে আলোচনার ফাঁকে অগ্রজ লেখক অংসুইদা বললেন বইটি তাঁর কাছে আছে কয়েকদিন পর নিজ উদ্যোগেই পাঠিয়ে দিলেন বইটি বইটি ছিল দ্বিতীয় সংস্করণ প্রথম সংস্করণটি প্রকাশিত হয়েছিল স্বর্গীয় বি, কে, রোয়াজার অবতরিকাসহ ১৯৬৬ সালে রাঙ্গামাটি থেকে আর দ্বিতীয় সংস্করণটি প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ সালে খাগড়াছড়ি থেকে প্রথম সংস্করণে গানের সংখ্যা ছিল ২৫টি আর দ্বিতীয় সংস্করণে কলেবর বর্ধন করে গানের সংখ্যা রাখা হয়েছে ৩৬টি ৩৬টি গান সন্নিবেশ করার পেছনেও কবি একটি সুন্দর যুক্তি দেখিয়েছেন এভাবে- ‘ত্রিপুরা জাতি ছত্রিশ দফায় বিভক্ত আবার ত্রিপুরার বিখ্যাত গরয়া নৃত্য ছত্রিশ তালে পরিবেশিত হয় তাই, আমি এই ক্ষুদ্র পুস্তিকায় ছত্রিশ কলির সমাবেশ ঘটাই

সংকলনের মোট ৩৬টি গানের মধ্যে তাঁর নিজের লেখা ২২টি গান রয়েছে সংকলনের কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া অনেকটা প্রতিটি গানের সাথে বাংলা অনুবাদ বা ভাবানুবাদ দেওয়া রয়েছে সাথে রয়েছে ক্ষেত্র বিশেষে ব্যাখ্যা, প্রেক্ষিত আলোচনা বা টিকা নিজের লেখা গান ছাড়া অন্য সবকটিতেই সেই গানের সৃষ্টির কথা, পেছনের কাহিনি এবং ত্রিপুরা সমাজ সংস্কৃতিতে সংশ্লিষ্ট গানের গুরুত্ব ব্যবহার ইত্যাদি সন্নিবেশ করা হয়েছে বাংলায় সংগ্রহ করা গানগুলোর মধ্যে মহাত্মা রতনমণি সাধুর একটি, বলংরায় সন্ন্যাসীর দুইটি, শিল্পী, সুরকার গীতিকার সুরেন্দ্র লাল ত্রিপুরার একটি, গীতিকার কবি মহেন্দ্র লাল ত্রিপুরার দুইটি, প্রভাংশু ত্রিপুরার একটি, কুমারী পারমিতা রোয়াজা হেপি একটি, গরয়ার নাচের গান একটি, ফাতং দফার প্রেমের গান একটি, সংগৃহিত লোকগীতি একটি, পুন্দা তান্নায় গীতিকাব্য থেকে অংশ বিশেষের গান একটি,  আর রোওনি বোওনি নামে বহুল প্রচলিত লোকগীতি একটি

এই গীতসংকলনের বইটি শুরু হয়েছে প্রখ্যাত গীতিকার মহেন্দ্র লাল ত্রিপুরার একটি গান দিয়ে লেখক যে এই গান দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত ছিলেন, তা সহজে বোঝা যায় বইটির প্রথম সংস্করণের মুখবন্ধ দেখে সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন- ‘..এই পাহাড় অঞ্চলের ভাবধারা সম্পূর্ণ পৃথক কারণ এখানে নেই নদীমাতৃক দেশের সুদূর দিগন্ত প্রসারি সমতল ভূমি যেখানে পদ্মার ঢেউয়ের তালে সুর মিলিয়ে রাখালিয়া বাঁশির মন মাতানো সুর .. এখানে পাহাড়ি ঝরণার নুপুরের রিনিঝিনি তালের সাথে তাল মিলিয়ে পাহাড়িয়া বাঁশির সুর উঁচু-নিচু পাহাড়ের গায়ে আছাড় খেয়ে কান্নায় গুমরে গুমরে উর্ধ-নীলাকাশে শূণ্যে বিলীন হয়ে যায় আর সে কান্নায় অবুঝ সরল পাহাড়ি মেয়ের চিকন-টানা চোখ বেয়ে ঝরতে থাকে অজস্র অশ্রæধারা এখানে দিনশেষে সূর্য মামা ক্লান্তি দূর করে সুউচ্চ পাহাড়ের কোলে আশ্রয় নিয়ে; দেখতে দেয় না তার সুদূর দিগন্ত প্রসারি নীড়

উপরের বিবৃতি যেন মহেন্দ্র লাল ত্রিপুরার লেখা সারিনি কামি বা জুমিয়া গাঁয়ে বিকেল গানের প্রথম কলিটারই প্রতিধ্বনি গানের কলি শুরু হয়েছে- ‘সাল রাজাসা থুনানি থাংকা ঐজাংনি হাপুং কতন, বাতি মুচুংগৈ সাতারাই দুমখা যত নকপতি নাইখন, থালি বলংগ জিরাওক চিরকখা আর চিরকখা চেরক, হুকবা হকথানি থুমজাগৈ ফাইখা যত কামিনি চেরক গানের বঙ্গানুবাদে বরেন ত্রিপুরা লিখেছেন- ঘুমিয়ে পড়েছে দিবসের মণি ওই পাহাড়ের গায়, প্রদীপ জ্বলেছে প্রতি ঘরে ঘরে ধূপের গন্ধ তায়, নিঝুম গেরাম পেয়েছে পরান, জুমিয়া ফিরেছে দিবা অবসান
 
রোওনি বোওনি নামে দুইবোনের দুঃখ গাঁথায় ভরা গীতিকাব্য হলো এইরোওনি বোওনি বরেণ্য এই লেখক-গবেষক বরেন ত্রিপুরা সংগৃহিত দুর্লভ এই গীতিকাব্যের কিছু চরণ নিম্নরূপ-

অরাই বফাং বাকলুলু
তকসা বথপ থুকলুলু
অরাই বফাংন তানখালাই
তকসা তংনানি আবেয়াল
লখি সিবিয়ই থাংখালাই
চুংবা তংনানি আবেয়াল
অথবা
দাংগা খামমানি বিন নুংগ
খাপাং খামমানি বিন নুংয়া
মায়ুং চিরিমুং খানা-
কপাল চিরিমুং খানায়া

ভাবানুবাদে লেখা হয়েছে- দোল দোলা দোল দোলা দোল, টুনীর বাসা দোল অরাই পাতার ঝোলা বাসায় পাতার সাথে দোল কাটে যবে অরাই গাছটি, বেহাল হয়রে বাচ্চা দুটি, মুখে নাইরে বোল তেমন মোদের দুঃখের জীবন বধূয়া ছাড়ে মোদের যখন, মোদের হৃদে বইবে তখন, শুধুই কান্নার রোল

ককবরকের আরেকটি জনপ্রিয় লোক গীতিকাব্যপুন্দা তান্নায় এই গীতিকাব্যের একটি আকর্ষনীয় অংশ তুলে আনা হয়েছেঅজানা পাহাড়ী সুরে গীতিকাব্যের অংশটি হলো-

“তৈফর দদিলি পদ্মফাং
পাতাল সুংজাকসে য়াফাংলাই
তৈফর জলাকার দারিঅ
বালাইসে কাচকগৈ তংবেলে
হানদুকগিরিতৈ পের বেলে।”

ভাবানুবাদে তিনি লিখেছেন- নীল আকাশের তারাগুলোর ন্যায় বিলের নীল পানিতে অসংখ্য পদ্মফুল থৈ থৈ জলে বিছানো পাতার উপর ভর দিয়ে ফোটে কিন্তু অস্তিত্বের সূত্র কোথায়? গভীর পানির তলদেশের কাদায় শিকড় গাড়া পাতালপরীগামী মূল যদি ঠিক না থাকে? তেমনি তুমিও বহুদূরে দেশ দেশান্তরে যাচ্ছো কষ্ট পাচ্ছ ক্লেশ পাচ্ছ তার মূলে কি কিছু অন্তর্নিহিত নেই?

এভাবে সংগৃহিত নিজের রচিত প্রতিটি গানের সাথে ভাবানুবাদ দেওয়ার পাশাপাশি তিনি কখনো প্রেক্ষিত বিশ্লেষন কিংবা ভাবার্থ বিবরণ দিয়েছেন তাঁর অন্যান্য গানগুলোর শিরোনাম হলো- একটি ঝরাগানের পংক্তি, পাহাড়ে বসন্ত, পাহাড়ি ঝরণা, সে কোন বালিকা, বনের পাখি, কূজনের ঠাঁই, একটি মনশিক্ষা গান, ত্রিপুরা তীর্থ ডুম্বুর, নিস্ফল জনম, তবু কেন, নারী, ফুরমৌনের ডাক, ফাতং দফার একটি ত্রিপুরা প্রেমের গান, পাহাড়ি মেয়ে, এসেছে কে, শাওন ধারা, বাঁশের বাঁশি, তব শূণ্যতায় রচিতে তোমায়, সেখানেতে হারিয়ে ছিলাম চপলনয়না, বিরহিনী, আশায় আশায়, জুমে ভাদর, সমর্পিতা, আঁখি জলে ভাসি একা, গরয়ার গান, বিষুদিনের স্মৃতি, খুমবার, তব অপেক্ষায় বসে আছি আমি, বিধি বাম. গাঁয়ে থাকতে চাই, ঘুম পাড়ানি ছড়া, মধু মাসের কান্না এবং সবশেষে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের বাংলা, ইংরেজী ত্রিপুরা ভার্সন সন্নিবেশ করা হয়েছে এই বইয়ে

গানগুলো সাজানোর ধারাবাহিকতা থেকে এই বই প্রকাশের উদ্দেশ্য স্পষ্টভাবে বোঝা যায় ত্রিপুরাদের লোকসমাজে প্রচলিত নানা সুরের সমতলের মানুষেরা তেমন কিছুই জানে না বললেও চলে পাহাড়িয়া সুরগুলোকে সমতলের দিগন্ত প্রসারি ধানের ক্ষেতের পাশে পদ্মার ঢেউয়ের সাথে তাল মিলিয়ে বাজানো রাখালিয়া বাঁশির মন মাতানো সুরের সাথে পাহাড়িয়া বাঁশির সুর মেলানোই এইঅজানা পাহাড়ী সুরসংগীত সংকলন বইটি প্রকাশের মূল উদ্দেশ্য ছিল
 
গানের সিলেকশন, সংগীতক্রম সাজানো, গানগুলোর ভাবানুবাদে প্রয়োগ করা ভাষা শৈলি সব মিলিয়ে বরেন্য এই লেখকের ভেতের বাস করা একজন রোমান্টিক কবিকে আবিস্কার করি আমরা তাঁর নিজের লেখা প্রতিটি গানেও তিনি ভাষা ছন্দ নিয়ে খেলেছেন দক্ষ খেলোয়াড়ের মতো প্রয়োগ করেছেন নানা লোক গীতিকাব্যের ছন্দ আর অলংকার, যার সাথে তিনি মিশিয়ে দিয়েছেন পরিমাণমতো আধুনিক ভাবনা বইটিকে সংগীত সংকলন বলা হলেও এখানে এমন অনেক সাহিত্যকর্ম রয়েছে, যাকে গানেরও উপরে কিছু একটা হিসেবে বিবেচনা করা যায় তাঁর লেখা বিদি করই বা বিধি বাম গানেই তাঁর এই সুর ছন্দ নিয়ে খেলা করার উৎকৃষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়, যেটিকে গান না বলে বরং কবিতা বলাই শ্রেয় ৭৮ লাইনের এই কবিতার উল্লেখযোগ্য কিছু অংশ হলো

“লখিয়ই ববই গিনাসা ববইয়ই
কার্তি মাসিনি সাদুং সাকুরু দাইঅ
চুমুই তখানো অংফুনি
নন খা কাগই লখিয়ই
মকল মুকতৈনো তৈ খাইয়ৈ
বাখা বুজাগৈ কাপগো
হানি দুগুনো আং মানো।”

গানটির স্বকৃত অনুবাদে তিনি লিখেছেন- বধূয়া গো বধূয়া, কেমনে রাখি আজি আমার ভাঙ্গা মন, কাক বর্ণ মেঘ আসি কার্তিকেরি রোদ নাশি আঁধার কালো মেঘে ঢাকি ছেয়ে যে নেয় সুন্দর ওই নীল গগন

বরেন্য সমাজ সেবক, সমাজ সংস্কারক, লেখক, কবি গীতিকার বরেন ত্রিপুরা আত্মনিবেদিত একজন গবেষক নিজের সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি তিনি প্রতিনিয়ত গবেষণা সাহিত্য চর্চা করে গিয়েছেন আজীবন সেই ১৯৬৬ সালে বইটি প্রকাশ হওয়ার সময়ে রচিত প্রথম সংস্করণের মূখপত্রে তিনি লিখেছেন- ‘আমার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা বিদগ্ধ কোন কবির মনে রেখাপাত করতে পারবে কিনা জানি না তবুও আমি আমার জাতির অর্ধবিলোপপ্রাপ্ত কৃষ্টি সংস্কৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করার সংকল্প নিয়েই লিখে যাব আমার ক্ষুদ্র গানের কলি- তথা- কবিতাগুচ্ছ তাঁর এই সংকল্প তিনি প্রমাণ করে গিয়েছেন তাঁর কর্মের মধ্য দিয়ে

লেখক: মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা, জাবারাং কল্যাণ সমিতির নির্বাহী পরিচালক মুক্ত গবেষক| 

[বি.দ্র: এই লেখাটি ২০১৭ সালের, ১৩ এপ্রিল প্রকাশিত ‘গিরিপ্রভা’ সাময়িকী থেকে সংকলিত]

No comments:

Powered by Blogger.